Mahalaya: পিতৃপক্ষ থেকে দেবীপক্ষের পবিত্র সংযোগ
আমাদের ধর্মগ্রন্থ, পুরাণ এবং শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে চলে আসা সংস্কারের আলোকে মহালয়া(Mahalaya) শুধু একটি দিন নয়, এটি এক গভীর আধ্যাত্মিক অনুভূতি। এই দিনে আমরা একদিকে পূর্বপুরুষদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাই, অন্যদিকে দেবী দুর্গার আগমনের সূচনা করি। তাই মহালয়া হলো এক অদ্বিতীয় মেলবন্ধন—পিতৃপক্ষের সমাপ্তি এবং দেবীপক্ষের সূচনা।
Pitru Paksha
মহালয়া বুঝতে হলে প্রথমে জানতে হয় পিতৃপক্ষ সম্পর্কে। পিতৃপক্ষ হলো ভাদ্র মাসের কৃষ্ণপক্ষের পনেরো দিন, যা সম্পূর্ণরূপে উৎসর্গ করা হয় আমাদের পূর্বপুরুষদের উদ্দেশ্যে। হিন্দু ধর্মে বিশ্বাস করা হয়, এই সময়ে পিতৃলোক থেকে আমাদের পূর্বপুরুষেরা পৃথিবীতে আসেন এবং তাঁদের আত্মীয়-স্বজনদের কাছ থেকে তর্পণ, পিণ্ডদান ও শ্রাদ্ধ গ্রহণ করেন।
তর্পণ মানে জল, তিল, কুশ ইত্যাদি দিয়ে পূর্বপুরুষদের তৃপ্ত করা। এই শ্রাদ্ধকর্ম সম্পাদন করলে তাঁদের আত্মা শান্তি পায় এবং তাঁদের আশীর্বাদ সন্তানের উপর বর্ষিত হয়। যদি কেউ এই সময় শ্রাদ্ধ না করে, তবে পিতৃদোষ দেখা দিতে পারে বলে পুরাণে বলা হয়েছে।
পিতৃপক্ষ আমাদের মনে করিয়ে দেয়, আমরা আমাদের পূর্বপুরুষদের ঋণী। তাঁদের আশীর্বাদেই আমাদের জীবন চলমান। তাই এই পক্ষ জুড়ে কৃতজ্ঞতা, শ্রদ্ধা এবং স্মরণ আমাদের কর্তব্য।
Mahalaya Date 2025
মহালয়া প্রতি বছর আশ্বিন মাসের কৃষ্ণপক্ষের অমাবস্যা তিথিতে পালিত হয়। এটি পিতৃপক্ষের শেষ দিন এবং দেবীপক্ষের সূচনা।
২০২৫ সালে মহালয়া পড়বে ২১ সেপ্টেম্বর (রবিবার)।
(বাংলা পঞ্জিকা এবং আঞ্চলিক তিথি গণনা অনুযায়ী এক-দুই দিনের পার্থক্য হতে পারে, তাই স্থানীয় পঞ্জিকা দেখা আবশ্যক।)
মহালয়ার সূচি ২০২৫
| সূচনা বিষয় | তথ্য |
|---|---|
| মহালয়ার তারিখ | রবিবার, ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৫ |
| অমাবস্যার শুরু সময় | ২১ সেপ্টেম্বর, রাত ১:০২ AM |
| অমাবস্যার শেষ সময় | ২২ সেপ্টেম্বর, রাত ১:৪২ AM |
| মহিষাসুর মর্দিনী রেডিও অনুষ্ঠান | ভোর ৪:০০ AM (পশ্চিমবঙ্গের স্থানীয় সময় অনুযায়ী) |
| পুর্বপুরুষ শ্রাদ্ধপাক বা পিতৃপক্ষের শেষ দিন | মহালয়ার অমাবস্যার দিন — ২১ সেপ্টেম্বর, ২০২৫ |
এই দিন থেকেই বাঙালির দুর্গাপূজার কাউন্টডাউন শুরু হয়।
What is Mahalaya
তাহলে প্রশ্ন আসে, মহালয়া কী?
মহালয়া হলো সেই পবিত্র দিন যেদিন পিতৃপক্ষের সমাপ্তি হয় এবং দেবীপক্ষ শুরু হয়। এই দিনে দুটি মূল দিক আছে—
- পিতৃতর্পণ: এদিন পূর্বপুরুষদের উদ্দেশ্যে তর্পণ ও শ্রাদ্ধ সম্পন্ন হয়। বিশ্বাস করা হয়, এদিন সব পিতৃ আত্মা ফিরে যান তাঁদের আবাসস্থলে। তাই এটি শেষ সুযোগ তাঁদের আশীর্বাদ প্রার্থনার।
- দেবী দুর্গার আহ্বান: বাংলার সংস্কৃতিতে মহালয়া মানেই দেবী দুর্গার পৃথিবীতে আগমন শুরু। বিশ্বাস করা হয়, মহালয়ার ভোর থেকেই দেবী দুর্গা কৈলাস ছেড়ে তাঁর বাপের বাড়ি, অর্থাৎ পৃথিবীতে আগমন করেন।
শব্দগতভাবে “মহা” মানে মহান, আর “আলয়” মানে আবাস। মহালয়া মানে মহান আগমন অথবা মহান আবাস।
Mahalaya Amavasya
মহালয়া পালিত হয় অমাবস্যা তিথিতে। তাই একে বলা হয় মহালয়া অমাবস্যা।
অমাবস্যার দিন শ্রাদ্ধকর্ম সর্বাধিক ফলদায়ক বলে শাস্ত্রে উল্লেখ রয়েছে।
যদি কারো পূর্বপুরুষের মৃত্যুবার্ষিকীর দিনে শ্রাদ্ধ সম্ভব না হয়, তবে এই দিনে তর্পণ করলে সব পূর্বপুরুষই তৃপ্ত হন। এজন্য একে সর্বপিতৃ অমাবস্যা বা পিতৃমোক্ষ অমাবস্যা বলা হয়।
এই দিন পূর্বপুরুষদের শান্তি ও মুক্তির জন্য পিণ্ডদান, তর্পণ, ব্রাহ্মণ ভোজন, দান ইত্যাদি করা হয়।
Significance of the Mahalaya Punna Snan
মহালয়ার ভোরে পুণ্যস্নান একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ আচার। একে বলা হয় মহালয়ার পুণ্য স্নান।
হাজার হাজার ভক্ত ভোররাতে গঙ্গা বা নিকটবর্তী নদীতে স্নান করেন। বিশ্বাস করা হয়, এই স্নানের মাধ্যমে শরীর ও মন পবিত্র হয়। এরপর নদীর জলে দাঁড়িয়ে কুশ, তিল এবং জল দিয়ে তর্পণ করা হয়।
পুণ্য স্নানের মাহাত্ম্য হলো—
- পূর্বপুরুষদের তৃপ্তি প্রদান
- পাপ থেকে মুক্তি
- নিজের অন্তরের পরিশুদ্ধি
- দেবীপক্ষের আরাধনার জন্য প্রস্তুতি
যখন গঙ্গার ধারে ভোরের আলোয় অসংখ্য মানুষ তর্পণ করেন, তখন সেই দৃশ্য আধ্যাত্মিক ভক্তিতে ভরে ওঠে।
Mahalaya Puja Rituals
মহালয়ার দিনে মূলত পূর্বপুরুষদের শ্রাদ্ধ ও দেবী দুর্গার আহ্বান এই দুই কেন্দ্র করে অনুষ্ঠান হয়।
প্রধান আচারগুলো হলো—
- তর্পণ: জল, কুশ, তিল, ফুল দিয়ে পূর্বপুরুষদের উদ্দেশ্যে অর্ঘ্য প্রদান। পুরুষ উত্তরাধিকারীরা দক্ষিণমুখী হয়ে তর্পণ করেন।
- পিণ্ডদান: কেউ কেউ আটা, চাল, তিল ও ঘি দিয়ে তৈরি পিণ্ড প্রদান করেন।
- ব্রাহ্মণ ভোজন: ব্রাহ্মণদের আহার করানো হয়, কারণ তাঁরা পূর্বপুরুষের প্রতিনিধি হিসেবে ধরা হয়।
- দান: দরিদ্র ও অভাবগ্রস্তদের খাদ্য, বস্ত্র, অর্থদান করা হয়।
- চোখ দান (চক্ষুদান): এই দিনে দুর্গার প্রতিমায় প্রথম চোখ আঁকা হয়। একে দেবীর প্রাণ প্রতিষ্ঠার সূচনা বলা হয়।
এইসব আচারের মাধ্যমে মহালয়া পূর্ণতা লাভ করে।
Mahishasura Mardini Radio Program
বাংলায় মহালয়া মানেই ভোরবেলা “মহিষাসুর মর্দিনী” রেডিও প্রোগ্রাম।
১৯৩১ সাল থেকে আকাশবাণী কলকাতা এই অনুষ্ঠান প্রচার শুরু করে। পঙ্কজ মল্লিক সুরারোপ করেন এবং বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র তাঁর অমর কণ্ঠে চণ্ডীপাঠ আবৃত্তি করেন।
ভোর চারটের সময় এই অনুষ্ঠান শোনার অভ্যাস এখনো বাঙালির মনে অটুট। পরিবার একত্রিত হয়, ভক্তি সংগীত, চণ্ডীপাঠ আর আবৃত্তি শুনে সবাই দেবী দুর্গার আগমন অনুভব করে।
আজও “জাগো তুমি জাগো” গানটি শুনলেই মনে হয়, দেবী দুর্গা আমাদের জীবনে আসছেন।
Importance of Mahalaya for Bengalis
বাঙালির কাছে মহালয়ার গুরুত্ব অপরিসীম।
- উৎসবের সূচনা: এই দিন থেকেই দুর্গাপূজার প্রস্তুতি শুরু হয়।
- ভোরের প্রার্থনা: মহিষাসুর মর্দিনী শুনে প্রতিটি পরিবার ভক্তিময় হয়।
- সংস্কৃতির পরিচয়: মহালয়া বাঙালির এক সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার।
- পারিবারিক সংযোগ: দাদা-দিদিমারা নাতি-নাতনিদের এই দিনের গল্প শোনান।
- আধ্যাত্মিক শক্তি: অমাবস্যার অন্ধকার কাটিয়ে দেবীপক্ষের আলো আমাদের জীবনে প্রবেশ করে।
তাই মহালয়া শুধু ধর্মীয় নয়, এটি সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং আধ্যাত্মিক মিলনক্ষেত্র।
উপসংহার
মহালয়া আমাদের শেখায়—
- পূর্বপুরুষকে স্মরণ করতে হবে
- দেবী দুর্গাকে আহ্বান করতে হবে
- আলো দিয়ে অন্ধকার দূর করতে হবে
এই দিনে আমাদের হৃদয় খুলে যায়, আমরা নতুন আশায় বুক বাঁধি। তাই সবাইকে আমি বলি—শুভ মহালয়া! মা দুর্গা সবার জীবনে শান্তি, সমৃদ্ধি ও কল্যাণ আনুন।
FAQs on Mahalaya
Q1: মহালয়া কি ছুটি?
হ্যাঁ, পশ্চিমবঙ্গে এটি সরকারী ছুটি।
Q2: মহিলারা কি তর্পণ করতে পারেন?
প্রথাগতভাবে পুরুষেরা করেন, তবে বর্তমানে অনেক পরিবার মহিলাদেরও তর্পণ করতে দেন। মূল কথা হলো ভক্তি।
Q3: মহালয়ার দিনে কী খাওয়া উচিত?
সাধারণত নিরামিষ খাদ্য গ্রহণ করা হয়। পেঁয়াজ, রসুন, আমিষ এড়ানো হয়।
Q4: মহালয়া ও দুর্গাপূজা কিভাবে সম্পর্কিত?
মহালয়া হলো দেবীপক্ষের শুরু। এই দিন থেকেই দুর্গার চোখ আঁকা হয় এবং তাঁর আগমন শুরু হয়।
Q5: মহিষাসুর মর্দিনী প্রোগ্রামের কাহিনি কী?
এতে দেবী দুর্গার জন্ম, মহিষাসুরের সঙ্গে তাঁর যুদ্ধ এবং মহিষাসুর বধের কাহিনি কাব্য, আবৃত্তি ও সংগীতে তুলে ধরা হয়।
