অসম্ভব সুন্দর প্রেমের কবিতা হলো এমন এক সাহিত্যের রূপ যা হৃদয়ের গভীর স্পন্দন থেকে উদ্ভূত হয়। এই কবিতাগুলো প্রেমের অনুভূতি, মমতা, ব্যথা ও আনন্দের মেলবন্ধন ঘটিয়ে জীবনের সবচেয়ে নাজুক ও মধুর মুহূর্তগুলোকে ছন্দময় ভাষায় প্রকাশ করে। প্রেমের এসব কবিতা শুধু ভাষার শ্রুতিমধুরতা নয়, বরং আবেগের গভীরতা, স্বপ্নের আকাশ এবং প্রতিটি হৃদয়স্পর্শী অনুভূতির এক অসাধারণ রূপকথা। অসংখ্য পাঠকের মনের ভেতর অমর হয়ে থাকে এই কবিতাগুলো, কারণ এগুলো ভালোবাসার সৌন্দর্যকে চিরস্থায়ী করে ধরে রাখে, যেখানে শব্দেরা সুরে, ছন্দে আর স্পর্শে জীবন্ত হয়ে ওঠে। এই ধরনের প্রেমের কবিতাগুলো হৃদয়কে উষ্ণতা দেয়, সম্পর্ককে দৃঢ় করে এবং ভালোবাসার অনন্ত রহস্য তুলে ধরে।
কাউকে ভালোবেসেছিলাম
জীবনানন্দ দাশ
কাউকে ভালোবেসেছিলাম জানি
তবুও ভালোবাসা,
দুপুরবেলার সূর্যে ভোরের শিশির
নেমে আসা,
ভোরের দিকে হৃদয় ফেরাই
যাই চলে যাই-
নীল সকালে যাই চলে যাই-
একটি নদী একটি অরূণ
শিউলি শিশির পাখি-
‘আমরা মায়ার মনের জিনিস
মায়াবিনীর বেলায় শুধু জাগি’
বলছে সে কোন্ ত্রিকোণ থেকে
ছায়ার পরিভাষা।
কাউকে ভালোবেসেছিলাম, জানি,
তবুও ভালোবাসা।
সে কোন্ সুদূর মরুর মনে চলে গেছ
হায়, যাযাবর তুমি,
সেইখানে কি মিলবে বনহংসী বাঁধা বাসা!
হায় বলিভূক, কখন ভেবেছিলে
মাটি ছেড়ে দূর আকাশের নীলে
ধূসর ডানার অগ্নি ছেড়ে দিলে
মিটে যাবে মায়াময়ী মাটির পিপাসা।
এত হাসি কোথায় পেলে
জসীমউদ্দীন
এত হাসি কোথায় পেলে
এত কথার খলখলানি
কে দিয়েছে মুখটি ভরে
কোন বা গাঙের কলকলানি।
কে দিয়েছে রঙিন ঠোঁটে
কলমী ফুলের গুলগুলানি।
কে দিয়েছে চলন বলন
কোন সে লতার দোল দুলানী।
কাদের ঘরে রঙিন পুতুল
আদরে যে টইটুবানি।
কে এনেছে বরণ ডালায়
পাটের বনের বউটুবানী।
কাদের পাড়ার ঝামুর ঝুমুর
কাদের আদর গড়গড়ানি
কাদের দেশের কোন সে চাঁদের
জোছনা ফিনিক ফুল ছড়ানি।
তোমায় আদর করতে আমার
মন যে হলো উড়উড়ানি
উড়ে গেলাম সুরে পেলাম
ছড়ার গড়ার গড়গড়ানি।
আমার এ প্রেম নয় তো ভীরু
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
আমার এ প্রেম নয় তো ভীরু,
নয় তো হীনবল
শুধু কি এ ব্যাকুল হয়ে
ফেলবে অশ্রুজল।
মন্দমধুর সুখে শোভায়
প্রেম কে কেন ঘুমে ডোবায়।
তোমার সাথে জাগতে সে চায়
আনন্দে পাগল।
নাচ’ যখন ভীষণ সাজে
তীব্র তালের আঘাত বাজে,
পালায় ত্রাসে পালায় লাজে
সন্দেহ বিহবল।
সেই প্রচন্ড মনোহরে
প্রেম যেন মোর বরণ করে,
ক্ষুদ্র আশার স্বর্গ তাহার
দিক সে রসাতল।
আকাশলীনা
জীবনানন্দ দাশ
সুরঞ্জনা, ওইখানে যেয়ো নাকো তুমি,
বোলো নাকো কথা ওই যুবকের সাথে;
ফিরে এসো সুরঞ্জনা :
নক্ষত্রের রুপালি আগুন ভরা রাতে;
ফিরে এসো এই মাঠে, ঢেউয়ে;
ফিরে এসো হৃদয়ে আমার;
দূর থেকে দূরে আরও দূরে
যুবকের সাথে তুমি যেয়ো নাকো আর।
কী কথা তাহার সাথে? তার সাথে!
আকাশের আড়ালে আকাশে
মৃত্তিকার মতো তুমি আজ ;
তার প্রেম ঘাস হয়ে আসে।
সুরঞ্জনা,
তোমার হৃদয় আজ ঘাস :
বাতাসের ওপারে বাতাস
আকাশের ওপারে আকাশ।
অমন আড়াল দিয়ে লুকিয়ে গেলে
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
অমন আড়াল দিয়ে লুকিয়ে গেলে
চলবে না।
এবার হৃদয় মাঝে লুকিয়ে বোসো,
কেউ জানবে না, কেউ বলবে না।
বিশ্বে তোমার লুকোচুরি,
দেশ বিদেশে কতই ঘুরি
এবার বলো আমার মনের কোণে
দেবে ধরা, ছলবে না।
আড়াল দিয়ে লুকিয়ে গেলে
চলবে না।
জানি আমার কঠিন হৃদয়
চরণ রাখার যোগ্য সে নয়
সখা, তোমার হাওয়া লাগলে হিয়ায়
তবু কি প্রাণ গলবে না।
না হয় আমার নাই সাধনা,
ঝরলে তোমার কৃপার কণা
তখন নিমেষে কি ফুটবে না ফুল
চকিতে ফল ফলবে না।
আড়াল দিয়ে লুকিয়ে গেলে
চলবে না।
অনেক ছিল বলার
কাজী নজরুল ইসলাম
অনেক ছিল বলার, যদি সেদিন ভালোবাসতে
পথ ছিল গো চলার, যদি দুদিন আগে আসতে
আজকে মহাসাগর স্রোতে চলেছি দূর পারের পথে
ঝরা পাতা হারায় যথা, সেই আঁধারে ভাসতে
যাই সেই আঁধারে ভাসতে।
গহন রাতি ডাকে আমায়, এসে তুমি আজকে
কাঁদিয়ে গেলে হায় গো আমার বিদায় বেলার সাঁঝকে
আসতে যদি হে অতিথি, ছিল যখন শুক্লা তিথি
ফুটতো চাঁপা, সেদিন যদি চৈতালী চাঁদ হাসতে।।
অনন্ত প্রেম
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
তোমারেই যেন ভালোবাসিয়াছি শত রূপে শতবার
জনমে জনমে যুগে যুগে অনিবার।
চিরকাল ধরে মুগ্ধ হৃদয় গাঁথিয়াছে গীতহার–
কত রূপ ধরে পরেছ গলায়, নিয়েছ সে উপহার
জনমে জনমে যুগে যুগে অনিবার।
যত শুনি সেই অতীত কাহিনী, প্রাচীন প্রেমের ব্যথা,
অতি পুরাতন বিরহমিলন কথা,
অসীম অতীতে চাহিতে চাহিতে দেখা দেয় অবশেষে
কালের তিমিররজনী ভেদিয়া তোমারি মুরতি এসে
চিরস্মৃতিময়ী ধ্রুবতারকার বেশে।
আমরা দুজনে ভাসিয়া এসেছি যুগলপ্রেমের স্রোতে
অনাদি কালের হৃদয়-উৎস হতে।
আমরা দুজনে করিয়াছি খেলা কোটি প্রেমিকের মাঝে
বিরহবিধুর নয়নসলিলে, মিলনমধুর লাজে–
পুরাতন প্রেম নিত্যনূতন সাজে।
আজি সেই চির-দিবসের প্রেম অবসান লভিয়াছে,
রাশি রাশি হয়ে তোমার পায়ের কাছে।
নিখিলের সুখ, নিখিলের দুখ, নিখিল প্রাণের প্রীতি,
একটি প্রেমের মাঝারে মিশেছে সকল প্রেমের স্মৃতি–
সকল কালের সকল কবির গীতি।
কাজল চোখের মেয়ে
সংগৃহীত কবিতা
শোনো, কাজল চোখের মেয়ে
আমার দিবস কাটে, বিবশ হয়ে
তোমার চোখে চেয়ে।
দহনের দিনে, কিছু মেঘ কিনে
যদি ভাসে মধ্য দুপুর
তবু মেয়ে জানে, তার চোখ মানে
কারো বুক পদ্মপুকুর।
এই যে মেয়ে, কজল চোখ
তোমার বুকে আমায় চেয়ে
তীব্র দাবির মিছিল হোক।
তাকাস কেন?
আঁকাস কেন, বুকের ভেতর আকাশ?
কাজল চোখের মেয়ে
তুই তাকালে থমকে থাকে
আমার বুকের বাঁ পাশ।
তোমার জন্য নিঃস্ব
সংগৃহীত কবিতা
তোমার জন্য কাঁদলে মন, নাম কি তার?
নিঘুম রাত জাগলে একা, দাম কি তার?
মোতার জন্য শূণ্য হলে, দায়টা কার?
অশ্রুজলে ভাসলে একা, যায়টা কার?
তোমার জন্য পথ হারালে, ভাববে কে?
নিখোঁজ খবর আসছে জেনে, কাঁদবে কে?
তোমার জন্য লিখলে চিঠি, পড়বে কে?
‘ভাববো না আর’ ভেবেও রোজ, লড়বে কে?
তোমার জন্য জ্বর বাঁধালে, মাপবে কে?
খানিক ছুঁয়েই লুকিয়ে একা, কাঁপবে কে?
তোমার জন্য নিঃস্ব হলে, নাম কি তার?
বোকাইতো সে, প্রেমিক বলে, দাম কি তার?